Drag

৪৮ আজিমপুর রোড, ঢাকা- ১২০৫, বাংলাদেশ।

এতিমখানায় দান করুন

প্রতিষ্ঠাতা নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ্ বাহাদুর

  • প্রতিষ্ঠাতা নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ্ বাহাদুর

  • ( ৭ জুন ১৮৭১ - ১৬ জানুয়ারি ১৯১৫)

জন্ম ও পারিবারিক জীবনঃ নওয়াব খাজা স্যার সলিমুল্লাহ্ , জেসিএসআই ( ৭ জুন ১৮৭১- ১৬ জানুয়ারি ১৯১৫, আহসান মঞ্জিল) ঢাকার চতুর্থ নওয়াব (ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত উপাধি) ছিলেন। তার পিতা নওয়াব খাজা আহসানউল্লাহ্ ও পিতামহ নওয়াব খাজা আব্দুল গনি। নওয়াব আহসানউল্লাহ্’র মৃত্যুর পর তাঁর জৈষ্ঠ পুত্র ৩০ (ত্রিশ) বছর বয়সী খাজা স্যার সলিমুল্লাহ্ ১৯০১ সালে পরিবারের দায়িত্ব গ্রহন করেন এবং নওয়াব উপাধিতে ভূষিত হন। পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার পূর্বে তিনি একজন ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ মৃত্যুকালে চার স্ত্রী, পাঁচ পুত্র ও তিন কন্যা রেখে যান। তাঁর সাতটি পুত্র জন্ম গ্রহণের তথ্য পাওয়া যায়ঃ

পুত্রগণের নামঃ (১) নওয়াব হাবিবুল্লাহ (২) আলিমুল্লাহ (৩) আব্দুল গণি (মৃত) (৪) হাফিজুল্লাহ (৫) নসরুল্লাহ (৬) গোলামুসসাকলাইন (মৃত) (৭) আহসানুল্লাহ।

কন্যাগণের নাম (১) ফরহাত বানু (২) আফতাব বানু (৩) খুরশিদ বানু (৪) আহমদী বানু। (সূত্রঃ ভূমি সংস্কার বোর্ড)

অবদানঃ (স্যার সলিমুল্লাহ্ মুসলিম এতিমখানা)-

 ১৯০৯ সনে ঢাকার তদানিন্তন নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ বাহাদুর তদীয় বাসভবনে “ইসলামিয়া এতিমখানা” নামক একটি অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৫ সনে তার মৃত্যুকাল পর্যন্ত উক্ত প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় ব্যয়ভার নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ্ বাহাদুর তাঁহার ব্যক্তিগত তহবিল হতে বহন করেন। অতঃপর এতিমখানাটি ঢাকার লালবাগে একটি ভাড়াটে অট্টালিকায় স্থানান্তরিত হয় এবং প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব একটি ব্যবস্থাপক কমিটির উপর অর্পন করা হয়। ১৯১৮ সনে পুনরায় এতিমখানাটি বর্তমান অবস্থানে অর্থাৎ ৪৮ নং আজিমপুর রোড, ঢাকায় একটি ক্ষুদ্র অট্টালিকায় স্থানান্তর করা হয়।

১৯২৩ সনের প্রথমার্ধ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় ছিলো। উক্ত সনের মে মাসে নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ্ বাহাদুরের জৈষ্ঠপুত্র নওয়াব হাবিবুল্লাহ বাহাদুরের সভাপতিত্বে ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠিত হয় এবং “স্যার সলিমুল্লাহ্ মুসলিম এতিমখানা” নামে নতুন নামকরণ করেন। প্রধানতঃ তাঁহারই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও কতিপয় বিশিষ্ট উদার ব্যক্তির সহায়তায় এতিমখানাটি বহু বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে ক্রমোন্নতির দিকে অগ্রসর হয়েছে। ঐ সমস্ত মহৎ প্রাণ ব্যক্তিদের প্রতি কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরুপ কাহারো কাহারো নাম অনুসারে এতিমখানার বিভিন্ন ভবন ও বিভাগের নামকরণ করা হয়েছে। ১৯৫৮ সনের ২৫শে নভেম্বর নওয়াব খাজা হাবিবুল্লাহ্ বাহাদুরের ইন্তেকালের পর তাঁহার সুযোগ্য পুত্র মেজর (অবঃ) নওয়াব খাজা হাসান আসকারী অত্র এতিমখানার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বর্তমানে এতিমখানাটি একটি কার্যনির্বাহী পরিষদ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ঃ 

নওয়াব সলিমুল্লাহ অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে চেয়েছেন পূর্ব বাংলায় একটি জ্ঞানবিভাসিত মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠুক, বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া বাঙালি মুসলমানের মধ্যে। ১৯০৬ সালের ২৭-২৯ ডিসেম্বর শাহবাগ বাগানবাড়িতে অনুষ্ঠিত ‘অল-ইন্ডিয়া মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্স’ এর ২০তম সভায় দেওয়া তাঁর ভাষণের ক্ষুদ্রাংশ পাঠ করেও স্যার সলিমুল্লাহ’র চিন্তার ধারা গভীরভাবে উপলব্ধি করা যায়, "...আমাদের শিক্ষার অবস্থা খুবই শোচনীয়। কলকাতায় ৩ জন অশিক্ষিতের অনুপাতে ১ জন শিক্ষিত অথচ ঢাকায় ৮ জন অশিক্ষিতের অনুপাতে মাত্র ১ জন শিক্ষিত লোক রয়েছে। ... অন্য কথায়, সমগ্র বঙ্গে প্রতি ১৬ জন মুসলমানের মধ্যে ১৫ জনই অশিক্ষিত। এতে আপনারা অনুধাবন করতে পারবেন যে, আমরা তথা মুসলমানরা শিক্ষায় কত পশ্চাৎপদ...।"  উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রায় দেড় হাজার ডেলিগেট, পাঁচ শতাধিক দর্শকসহ মোট প্রায় দুই হাজার লোক এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন যার যাবতীয় ব্যয় বহন করেন সলিমুল্লাহ।

সম্মেলন শেষে ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর সলিমুল্লাহর প্রস্তাবে গঠিত হয় ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’। নতুন প্রদেশ গঠনের সময় থেকেই নওয়াব সলিমুল্লাহ, নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ অন্য নেতাদের দাবি ছিল ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার। গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা সফরে আসেন। স্যার সলিমুল্লাহসহ সহযোগী নেতারা হার্ডিঞ্জের সঙ্গে দেখা করলে তিনি আশ্বাস দেন, প্রদেশ বাতিলের ক্ষতিপূরণস্বরূপ ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। ঢাকার মতো একটি অবহেলিত ও অনগ্রসর প্রাচীন নগরীতে একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি তখন অনেকের কাছেই ছিল অযৌক্তিক।  নওয়াব আলী চৌধুরী, এ কে ফজলুল হকসহ পূর্ববঙ্গের মুসলিম নেতাদের নিয়ে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জোর দাবি তোলেন তিনি। সরকার এই দাবি ১৯১২ সালে মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিলে এর বিরুদ্ধেও যে প্রবল আন্দোলন হয়েছিল, সে কথা সুবিদিত। তবে শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও তিনি নিজে এর প্রতিষ্ঠা দেখে যেতে পারেননি। কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, সমাজসংস্কারক, প্রশাসকসহ গত ৯৮ বছরে যে বিদ্বৎসমাজ তৈরি হয়েছে, তার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা নওয়াব সলিমুল্লাহর অবদান অনস্বীকার্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য স্যার সলিমুল্লাহ ৬০০ একর জমি দান করেছেন, এমন একটি গুঞ্জন ও মুখরোচক আলোচনা মুখপুস্তিকার দেয়ালগুলোতে দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে দান করার মতো জমি নওয়াব পরিবারের ছিল না। বাংলাপিডিয়ার তথ্যানুযায়ী, বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনার আওতায় পূর্ববাংলা ও আসাম সরকারের প্রশাসনিক দপ্তর প্রতিষ্ঠার জন্য রমনা এলাকায় এর আগে অধিগ্রহণ করা ২৪৩ একর ভূমি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নির্ধারিত হয়। সে সময়কার ভূমিসংক্রান্ত পরিপূর্ণ রেকর্ড ঢাকা কালেক্টরেটে রয়েছে। পূর্ব বাংলার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে নওয়াব সলিমু্ল্লাহর নানামুখী অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্রদের প্রথম ছাত্রাবাসের নাম রাখা হয় ‘সলিমুল্লাহ মুসলিম হল’। সলিমুল্লাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ইসলামিয়া এতিমখানাটি তাঁর মৃত্যুর পর নামকরণ করা হয় ‘সলিমুল্লাহ এতিমখানা’। ( সূত্রঃ প্রথম আলো- ১৬.০৬.২০১৯ খ্রিঃ)

মিটফোর্ড হাসপাতালঃ রবার্ট মিটফোর্ড নামে ঢাকার এক সাবেক জেলা প্রশাসকের প্রদত্ত অর্থ দিয়ে ১৮৫৮ সালে মিটফোর্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। কালের পরিক্রমায় ১৮৭৫ সালে স্থাপিত হয় ঢাকা মেডিকেল স্কুল। মিডফোর্ড হাসপাতালের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে এই মেডিকেলে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের অধ্যয়ন চলমান থাকে। ১৯৬২ সালে স্কুলটিকে কলেজে রূপান্তর করা হয়। নামকরণ করা হয় ‘মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ’। পরবর্তীতে নাম বদলে রাখা হয় ‘স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ’। বর্তমানে হাসপাতাল ও কলেজ মিলে পূর্ণ নাম ‘স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল’।

বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)- প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা বুয়েটের শুরু ১৮৭৬ সালে ঢাকা সার্ভে স্কুলের মাধ্যমে। ১৯০২ সালে তৎকালীন সরকার সার্ভে স্কুলকে ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে রূপান্তরের পরিকল্পনা নিলে অর্থাভাবে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছিল না। নওয়াব আহসানুল্লাহ সে সময় ১ লক্ষ ১২ হাজার টাকা দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে তিনি ইন্তেকাল করলে পরবর্তী সময়ে নওয়াব সলিমুল্লাহ সেই অর্থ পরিশোধ করেন। বিদ্যায়তনটির নামকরণ করা হয় ‘আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল’। ১৯৪৭ সালে এটি কলেজে উন্নীত করা হয়। ১৯৬২ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নাম দেওয়া হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়’। মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’।

রাজনৈতিক জীবনঃ  ১৯০৩-০৪ সালে ইংরেজ সরকারের বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনার ওপর মতামত দিতে গিয়ে নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ১৯০৪ সালের ১১ জানুয়ারি পূর্ববঙ্গের হিন্দু-মুসলিম নেতৃবৃন্দকে নিয়ে আহসান মঞ্জিলে এক সভা করে সরকারের বঙ্গবিভাগ পরিকল্পনার কিছু বিষয় বিরোধিতা করেন। তিনি পূর্ববঙ্গের অধিবাসীদের সুবিধার্থে ঢাকাকে রাজধানী করে বৃহত্তর প্রদেশ গঠনের এক বিকল্প প্রস্তাবও দেন। ভাইসরয় লর্ড কার্জন পূর্ববঙ্গ সফরে এসে ১৯০৪ সালের ১৮-১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় নওয়াব স্যার  সলিমুল্লাহর আতিথ্য গ্রহণ করেন। ওই সময় তাঁদের মধ্যে আলোচনার ফলে বঙ্গ বিভাগ পরিকল্পনায় কিছু পরিবর্তন আসে। এরপর ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গবিভাগ কার্যকর হলে ঢাকা নতুন পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী হয়। কংগ্রেসের বিরোধিতার মুখে বঙ্গবিভাগ টিকিয়ে রাখার পক্ষে জনমত সংগঠিত করার ব্যাপারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নতুন প্রদেশ প্রতিষ্ঠার দিনেই তাঁর সভাপতিত্বে ঢাকার নর্থব্রুক হলে পূর্ববঙ্গের নেতৃস্থানীয় মুসলিমদের সমন্বয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভা থেকে গঠিত হয় ‘Mohammedan Provincial Union’ নামে একটি রাজনৈতিক সমিতি। সে সময়ে এ সমিতি বাঙালি মুসলিমদের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্লাটফরম হিসেবে কাজ করে। স্যার সলিমুল্লাহ তাঁর সহযোগীদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন মফস্বল শহরে সভা করে নতুন প্রদেশের অনুকূলে জনমত সৃষ্টি করেন। অন্যদিকে কংগ্রেস এর বিরোধিতায় আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯০৬ সালে স্যার সলিমুল্লাহ ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রাদেশিক শিক্ষা সমিতি’ গঠন করেন। ওই বছরেই ১৪ ও ১৫ এপ্রিল ঢাকার শাহবাগে অনুষ্ঠিত সমিতির প্রথম অধিবেশনে তিনি এর সভাপতি নির্বাচিত হন। 

১৯০৬ সালে স্যার সলিমুল্লাহ ‘Muslim All India Confederacy’ নামে একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তাঁর পরিকল্পনাটি বিবেচনার জন্য উপমহাদেশের বিভিন্ন নেতা ও সমিতির নিকট প্রেরণ এবং পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। অন্যদিকে আলীগড় আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট নেতাদের অনুরোধ করে ‘নিখিল ভারত মুসলিম শিক্ষা সমিতি’ (All India Mohammedan Educational Conference)-এর ২০তম অধিবেশন তিনি সম্পূর্ণ নিজ ব্যয়ে ঢাকায় আয়োজনের ব্যবস্থা করেন। ১৯০৬ সালের ২৭ থেকে ৩০ ডিসেম্বর নবাবের শাহবাগস্থ পারিবারিক বাগান-বাড়িতে সর্বভারতীয় মুসলিম নেতৃবৃন্দসহ প্রায় দুই হাজারের বেশি সুধী যোগ দেন। উক্ত অধিবেশনের শেষ দিন ৩০ ডিসেম্বর নওয়াব সলিমুল্লাহর প্রস্তাবনায় ‘All India Muslim League’ গঠিত হয়। তিনি এর সহ-সভাপতি এবং গঠনতন্ত্র তৈরি কমিটির সদস্য মনোনীত হন। ১৯০৭ সালে নওয়াব সলিমুল্লাহ সংগঠনের শাখা স্থাপনের উদ্দেশ্যে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, পাবনা, কুমিল্লা প্রভৃতি স্থানে জনসভা করেন। ১৯০৭ সালের ৪ মার্চ কুমিল্লায় এ ধরনের একটি সভায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধীরা বাধা দেয়, তা সত্বেও নওয়াব সলিমুল্লাহ তাঁর কর্ম-তৎপরতা অব্যাহত রাখেন। একই বছর কলকাতায় উভয় বঙ্গের মুসলিম নেতৃবৃন্দের এক সভায় ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম লীগ’ (All Bengal Muslim League) গঠিত হয় এবং তিনি এর সভাপতি মনোনীত হন। ১৯০৮ সালের জুন মাসে তিনি ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগ’ গঠন করে এর সেক্রেটারি হন। একই বছর ২৭ ডিসেম্বর অমৃতসরে নওয়াব সলিমুল্লাহ’র সভাপতিত্বে ‘নিখিল ভারত মুসলিম শিক্ষা সমিতি’র ২২তম সভা হয়। সেখানে ৩০-৩১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সভায় তিনি মুসলিমদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচন দাবি করেন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে রাজনৈতিক আলোচনার সুযোগ দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানান। নতুন প্রদেশে হিন্দু মুসলিমদের সুসম্পর্ক রক্ষার জন্য তিনি উভয় সম্প্রদায়ের সম্পদশালী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে ১৯০৯ সালের ২১ মার্চ ‘Imperial League of Eastern Bengal and Assam’ গঠন করেন। এ বছরেই তিনি প্রাদেশিক মুসলিম লীগ পুনর্গঠন এবং এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

১৯১২ সালের ২ মার্চ নওয়াব সলিমুল্লাহর সভাপতিত্বে কলকাতায় ডালহৌসী ইনস্টিটিউটে যুক্তবঙ্গের মুসলিম নেতৃবৃন্দের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় তাঁর প্রস্তাবের ভিত্তিতে উভয় বাংলার স্বতন্ত্র দুটি লীগকে একত্র করে ‘প্রেসিডেন্সি মুসলিম লীগ’ গঠিত হয় এবং তিনি এর সভাপতি নির্বাচিত হন। ওই সভায় অনুরূপভাবে উভয়বঙ্গের মুসলিম সমিতি দুটিকে একত্র করে গঠিত হয় ‘বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি মুসলিম অ্যাসোসিয়েশন’। তিনি এ সংগঠনেরও সভাপতি হন। ১৯১২ সালের ৩-৪ মার্চ কলকাতায় অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সভায় সভাপতির ভাষণে তিনি পূর্ববঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাকারীদের যুক্তি খন্ডন করেন। তিনি মুসলিমদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন এবং সরকারি চাকরিতে তাঁদের সংখ্যানুপাতে কোটা ধার্যের দাবি জানান। ১৯১৪ সালের ১১-১২ এপ্রিল তিনি ঢাকায় যুক্তবঙ্গের মুসলিম শিক্ষা সমিতির অধিবেশন এবং ১৩ এপ্রিল প্রেসিডেন্সি মুসলিম লীগের অধিবেশন আহবান করেন। এরপরই তিনি কার্যত কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর নেন।

নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ্ পূর্ব বাংলার মুসলমানদের উন্নয়নে শিক্ষা, কৃষি, শিল্প খাতে ও মসজিদ, মাদ্রাসা, হাসপাতাল, ছাত্রাবাস নির্মাণে এবং অন্যান্য যে কোনো ধরনের সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে তিনি পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।

ঢাকার কারুশিল্পের উন্নয়নে তিনি প্রদর্শনীর আয়োজন করতেন। তাঁর প্রচেষ্টায় এ শিল্প নবরূপ পায়। কারুশিল্পের উন্নয়নে ১৯০৯ সালে পূর্ববঙ্গ সরকার গঠিত কমিটির তিনি একজন সদস্য ছিলেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ১৯০২ সালে সি.এস.আই, ১৯০৩ সালে নওয়াব বাহাদুর, ১৯০৯ সালে কে.সি.এস.আই এবং ১৯১১ সালে জি.সি.এস.আই উপাধি প্রদান করে।

১৯১৫ সালের ১৬ জানুয়ারি তাঁর ঘটনাবহুল জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। অসুস্থ অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়েছিল কলকাতায় ৯৩ চৌরঙ্গী রোডের বাড়িতে। ১৬ জানুয়ারি বিকেল ৪টায় কলকাতায় আলিয়া মাদরাসা সংলগ্ন ওয়েলসলি স্কোয়ার পার্কে নামাজে জানাজা শেষে ১৭ জানুয়ারি নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ্ বাহাদুরের লাশ ঢাকায় আনা হয়। ঢাকায় দুটি জানাজা শেষে নওয়াবকে দাফন করা হয় পুরান ঢাকা বেগমবাজার পারিবারিক গোরস্তানে।

তার অকাল মৃত্যু নিয়ে রয়েছে নানা কৌতূহল, নানা প্রশ্ন, নানা জল্পনা-কল্পনা। অনুসন্ধানকারীদের অনুসন্ধিৎসু মন আজও খুঁজে বেড়ায় তার রহস্যময় মৃত্যু ঘটনার কারণ। কেন অকালে ঝড়ে গেলেন বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ প্রাণ, মুক্তির দূত, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রেরণা নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ ? এ কথা বলতে দ্বিধা নেই ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠন এবং ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না হলে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ বলতে কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকত কি না প্রশ্ন থাকে। তাই এটাই স্বতঃসিদ্ধ যে, বঙ্গভঙ্গ, মুসলিম লীগ গঠন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতার অগ্রজ হিসেবে নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ্ই বাহাদুরই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নপুরুষ।

নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ’র মৃত্যু প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদ কবি ফারুক মাহমুদ বলেন, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে বড়লাটের সাথে নওয়াবের মতবিরোধ দেখা দেয় এবং উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। এক পর্যায়ে বড়লাট নওয়াবকে অপমানজনক কথা বলেন যা তার সহ্য হয়নি। নওয়াবের সাথে সব সময় একটি ছড়ি থাকত। সে ছড়ি দিয়ে নওয়াব বড়লাটের টেবিলে আঘাত করেন। এ নিয়ে চরম তির্যক বাদানুবাদ শুরু হয়। এক পর্যায়ে বড়লাটের ইঙ্গিতে তার দেহরক্ষী নওয়াবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন এবং গুরুতর আহত হন। পরে নওয়াবের মৃত্যু হয়। নিশ্চিদ্র প্রহরায় নবাবের লাশ ঢাকায় আনা হয়। তার আত্মীয়স্বজনকেও লাশ দেখতে দেয়া হয়নি। ১৯১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি সামরিক প্রহরায় বেগম বাজারে তাকে দাফন করা হয়। (সরকার শাহাবুদ্দিন আহমদ : আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল, প্রথম খণ্ড, পৃ. ২২১)

মাত্র ৪৪ বছরের জীবনে নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ্ বাহাদুর সর্বভারতীয় পর্যায়ে যতটুকু প্রভাব ফেলতে পেরেছিলেন তা তাঁর উত্তর ও পূর্বপুরুষদের কেউই পারেননি। তিনি নিজ জনগোষ্ঠী ও পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বাংলাদেশ ভূখণ্ডের প্রতি বিশেষ সহানুভূতিশীল ছিলেন। তাঁর আত্মত্যাগ যুগ যুগ স্মরণ করবে আপামর জনতা। নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ’র প্রতি তাঁর প্রতিষ্ঠিত “ স্যার সলিমুল্লাহ্ মুসলিম এতিমখানার” পক্ষ হতে রইলো গভীর শ্রদ্ধা।

 

সংগ্রহেঃ মোঃ হারুন অর রশীদ

তত্ত্বাবধায়ক, স্যার সলিমুল্লাহ্ মুসলিম এতিমখানা

৪৮ আজিমপুর রোড, ঢাকা-১২০৫।